শুধু কোরআনের সহজ বাংলা অনুবাদ পাঠ যথেষ্ট নহে । যাহারা অনুবাদ সহ কুরআন
তেলাওয়াত করিয়া থাকেন , তাহাদের মধ্যে এই ক্রটি পরিলক্ষিত হয় যে তাহারা
কুরআনের বাংলা অনুবাধ পড়িয়া তাহার সঠিক ব্যাখ্যা খুজার চেষ্টা করেন না ।
এখন কুরআনের অর্থ অনুধাবন করার অর্থ এই নয় যে, কুরআন অর্থ সহ পড়িয়া তাহার
ভাবার্থ অনুধাবন করার চেষ্টা করিতে হইবে । শুধুমাত্র অর্থসহ কুরআন পড়িয়া
তাহার মূল অর্থ বোঝা সবার জন্য সম্ভব নহে । সত্য বলিতে গেলে বিজ্ঞ আলেম
ছাড়া সাধারণ মানুষ এর কাজ তা নয় ।
অনেক স্হলে দেখা গিয়েছে , শুধুমাত্র অনুবাদ পাঠ করিয়া কোরআনের অনেক কিছুই
বোঝা সম্ভবপর নহে । কেননা, কুরআনে এমন অনেক বিষয় বস্তু রহিয়াছে যাহা বুঝিতে
হইলে ব্যাকরণশাস্ত্র, অলংকারশাস্ত্র ও মানসুখ অর্থাৎ রহিত ও রহিতকারী আয়াত
সমূহ , ওছুল এবং ফেকাহ প্রভৃতি কতিপয় শাস্ত্রে বুৎপত্তি থাকা একান্ত
প্রয়োজন । এই প্রাথমিক শাস্ত্রগুলিতে যতক্ষণ পর্যন্ত কেহ জ্ঞান লাভ না
করিবে ততক্ষণ পর্যন্ত কাহারও কুরআনের সরল অনুবাদ পাঠ করিয়া তাহার ব্যাখ্যা
করা কোনরূপেই উচিত নয় । করিলে তাহাতে ভূল হওয়ার সমূহ সম্ভাবনা রহিয়া যায় ।
অথচ আজকাল কিছূ মানুষ তাহাই করিতেছে । হাদিসেও কঠোর নিষেধ আছে আলেম ছাড়া
যে কারোর-ই কুরআনের ব্যাখ্যা প্রদান না করার বিষয়ে।
তদুপরি সবচেয়ে বড় সমস্যা এই যে, কোন কিছূ বুঝিতে অক্ষম হইলে অপরের নিকট
জিজ্ঞাসা করিয়া অবগত হওয়ার অভ্যাস আজকাল মানুষের মধ্যে অতি বিরল । কোন
বিষয়ে সন্দেহ জন্মিলে অধিকাংশ লোকই নিজের বিবেকানুযায়ী উহার কোন না কোন
অর্থ আবিস্কার করিয়া লয় । ইহার ফলে অধিকাংশ ক্ষেত্রেই ভুল সিন্ধান্তে আসার
ফলে ঈমান ও আকীদাও নষ্ট হয় । (যেমন এক ব্লগার লিখিয়াছেন কুরআন অনুসারে
ইহুদী থেকে মুসলমান না হইলেও নাকি কোন সমস্যা নাই অথচ এ ব্যাপারে মহানবী
(সাঃ) স্পষ্ট হাদিস আছে মহানবী (সাঃ) আসার পর ইসলাম গ্রহণ ছাড়া যেই মৃত্যু
বরণ করবে তার দ্বীন গ্রহণ যোগ্য হইবে না)
এখন আমাদের মত সাধারণ মানুষের উপায় কি ? উপায় হইলো কোন বিজ্ঞ ও পরিচিত আলেম
দ্বারা লিখিত কুরআনের তাফসীর ও ব্যাখ্যা পাঠ করা । এখন এজন্য বিজ্ঞ আলেম ও
উনার লেখার অনুসন্ধান খুবই জরুরী ।
আসুন একটা উদাহরণ দিয়ে আলোচনা কারা যাক । ধরা যাক একটি শহরে দুই জন চিকিৎসক
রহিয়াছেন । একজন চিকিৎসাশাস্ত্রে অত্যন্ত পারদর্শী । উনার রোগ নির্ণয় এবং
ওষুধ নির্বাচনে কোন ভূল সাধারণত হয় না । কিন্তু ভাষাগত দিক দিয়ে তিনি
অত্যন্তু দুর্বল এবং চুপ চাপ স্বভাবের ব্যাক্তি । অপরদিকে অন্য চিকিৎসক
ভাষা গত দিকে দিয়ে অনেক পটু । কথা দিয়ে মানুষের মন জয় করে ফেলেন । কিন্তু
চিকিৎসা শাস্ত্রে অতটা দক্ষ ও বিচক্ষণ নহেন । এখন আপনারা ভাবিয়া বলূন,
আপনাদের রোগ হইলে আপনারা কার নিকট ওষুধের জন্য যাইবেন ? নিশ্চয়ই যে চিকিৎসা
ভালো জানে তার নিকট । কেননা রোগ মুক্তি-ই উদ্দেশ্য , কথা শুনে খুশী হওয়ার
জন্য নয় ।
বন্ধুগণ ! আমরা যদি কুরআন শরীফকে আমাদের 'রূহানী' রোগের চিকিৎসা গ্রন্হ মনে
করি তাহলে উহার তরজমা ও তাফসীর গ্রন্হ নির্বাচনের বেলায়ও একজন নির্ভরযোগ্য
বিজ্ঞ আলোমের তাফসীর ও ব্যাখ্যা নির্বাচন করাও জরুরী । কোন তরজমা ভাষার
দিক দিয়া চাকচিক্যময় হইলেও তাহা যদি একজন বিজ্ঞ ও নির্ভরযোগ্য আলেমের না হয়
তবে তাহা অবশ্যই পরিত্যাজ্য ।
বন্ধুগণ ! দুনিয়াবী কাজ কর্মের প্রতি লক্ষ্য করুন । সামান্য সামান্য
কাজগুলিও উস্তাদের নিকট না শিখিলে কেহ নিজে নিজে আয়ত্ব করিতে পারেনা ।
এমনকি কাঠ মিস্ত্রির কাজ যদি কেহ উস্তাদ ব্যতীত নিজে নিজে শিখিতে আরম্ভ করে
তবে সে নিশ্চয়-ই নিজের হাত-পা কাটিয়া ফেলিতে আরম্ভ করিবে । অথচ প্রত্যেক
মানুষ জীবনে বহু কাঠ মিস্ত্রিকে স্বচক্ষে আসবাব পত্র বানাইতে দেখিয়াছে ।
কিন্তু এক্ষেত্রে কেহ এরূপ বলে না যে, আমি কাঠ মিস্ত্রিকে চেয়ার বানাইতে
দেখিয়াছি , সুতরাং আমিও তাহা তৈরী করিতে পারিব । দুনিয়াবী সমস্ত কাজে আমরা
জানি যে, শিক্ষকের নিকট শিক্ষা ব্যতীত আমরা তাহা শিখিতে পারিবনা , করিতে
পারিব না ।
কিন্তু নিতান্ত পরিতাপের বিষয় এই যে, পবিত্র কুরআন শরীফকে আমরা খুবই সাধারণ
গ্রন্হের পর্যায়ে নিয়া গিয়াছি । কোন শিক্ষকের নিকট ইহা শিক্ষা করা
ব্যতীত-ই আমরা ইহার অনুবাদ পড়িয়া ব্যখ্যা করা শুরু করিয়া দিয়াছি । যার ফলে
আমরা নিজেরাও ধ্বংস হইতেছি এবং অন্যকেও যাদেরকে এই ব্যাখ্যা শুনাইতেছি ও
পড়াইতেছি , তাদেরকেও ধ্বংস করিতেছি ।
অনুগ্রহ করে আমরা এরূপ বিপদজনক কাজ হইতে বিরত হই এবং অন্যদেরকেও সাধবান করিয়া দেই যাহারা এরূপ কাজ করিতেছে ।
আল্লাহ আমাদের সকলকে কুরানের সঠিক অনুবাদ ও তাহার ব্যাখ্যা জানার তৈাফিক দান করুন । আমিন ।
সূত্রঃ মাওয়া-ই-আশরাফিয়া । মাওলানা আশরাফ আলী থানবী (রহঃ) । এমদাদিয়া লাইব্রেরী । চক বাজার, ঢাকা ।
No comments:
Post a Comment